Header Ads Widget

কালীয়দমন

কালীয় নাগের পূর্বজন্মের কথা ।


অনেককাল আগে দুজন মুনি ছিলেন, একজনের নাম অশ্বশিরা, অন্যজনের নাম দেবশিরা। একদিন দেবশিরা মুনি বনে বসে একান্তে জপ করছিলেন। সেই সময়ে সেখানে অশ্বশিরা মুনি আসলেন। এবং দেবশিরা মুনির নিকটেই সাধনা করার জায়গা খুঁজতে লাগলেন। দেবশিরা মুনির জপ ভঙ্গ হল, তিনি চোখ খোলে অশ্বশিরা মুনিকে দেখলেন, এবং জিজ্ঞেস করলেন, সেখানে আগমনের কারণ। আগন্তুক মুনি বললেন, তিনি সাধনার জায়গা খুঁজছেন। দেবশিরা আগন্তুক মুনিকে মানা করলেন, তার কাছাকাছি যেন সাধনায় না বসেন। অশ্বশিরা মুনি দেবশিরার কথা না শুনেই কুশাসন পেতে বসতে গেলেন। তা দেখে ক্রোধিত হলেন দেবশিরা, আর উঠে গিয়ে আসন ছুঁড়ে ফেলে দিলেন। দুজনেই ক্রোধিত হয়ে গেলেন। অশ্বশিরা ক্রোধিত হয়েই কমুণ্ডুল থেকে জল হাতে নিয়ে অভিশাপ দিলেন দেবশিরাকে, আপনি ক্রোধিত হয়ে সাপের মত আচরণ করছেন, আপনি সাপ হয়ে যাবেন আর ঈগলের ভয়ে ভীত থাকবেন। দেবশিরাও কম জান না। তিনিও কমুণ্ডুল থেকে জল হাতে নিয়ে অশ্বশিরাকে অভিশাপ দিলেন, আপনি কাকের মত আচরণ করছেন, আপনি কাক হয়ে যাবেন। দুজনেই মুনি, জ্ঞানী এবং সাধক। তাদের এই কাণ্ড দেখে সেখানে বিষ্ণুদেব দেখা দিলেন। বললেন, এত জ্ঞানী হয়ে যদি এরকম আচরণ করে তাহলে সাধারণ মানুষ কি করবে ? দুজনে লজ্জিত হলেন। তারা ক্ষমা চাইলেন। ঐদিকে ধনুক থেকে তীর বেরিয়ে গেলে যেমন ফেরানো যায় না, মুখ থেকে কথা বেরিয়ে গেলেও ফেরানো যায় না। মুনি মুখের কথা, দাম তো রাখতেই হবে। বৃথা যায় না। বিষ্ণুদেব বললেন, দেবশিরা শ্রীকৃষ্ণের পদচিহ্ন মাথায় নিয়ে গরুড় মানে ঈগলের ভয় থেকে মুক্ত হবেন। আর অশ্বশিরাকে বললেন, অশ্বশিরা কাক হবেন, কাক হলেও জ্ঞানী হবেন, ত্রিকালদর্শী হবেন। শ্রীকৃষ্ণকে তার বাবা বসুদেব গোকুলের গোয়ালা নন্দের ঘরে রেখে এসেছিলেন। গোকুলের পাশেই ছিল যমুনা নদী। সেই যমুনা নদীতেই থাকত কালী নাগ, যে দেবশিরা ছিল। তার কুকীর্তির কারণে তার বিষে জল বিষাক্ত ছিল আর পরিবেশও দূষিত ছিল। শ্রীকৃষ্ণের কালীয় দমন কাহিনী অনুসারে শ্রীকৃষ্ণ তাকে শাস্তি দিয়েছিলেন, আর তার মাথায় উঠে নৃত্য করেছিলেন। ঐদিকে অশ্বশিরা কাক হয়ে কাক-ভূষণ্ডি হয়েছিলেন। আর রামভক্ত ছিলেন। গরুড়ের কাছে রামভক্তির কথা বলেছিলেন একটি সরোবরের(লেক) ধারে বসে। এটাকে কাক-ভূষণ্ডি সরোবর বলা হয়। হিমালয় পর্বতের অন্নপূর্ণা রেঞ্জের তিলিচো(Tilicho ) হ্রদ হচ্ছে কাক-ভূষণ্ডি সরোবর। তুলসীদাসের রামায়নে কাক-ভূষণ্ডির বিস্তারিত কথা আছে। তবে কাহিনী উপরের কাহিনী থেকে ভিন্নভাবে আসে। অশ্বশিরার কাক কাহিনীতে বলা আছে, বিভিন্ন সময়ে তিনি বিভিন্ন কীর্তি করে অভিশাপ পেয়েছিলেন। সে হিসেবে কোথাও হয়তো দুই দিকটাই মিলানো যাবে। আপাতত আমার জানা নেই। গরুড় মানে ঈগল, রামের ইতিহাস কাক-ভূষণ্ডি মানে কাকের কাছ থেকে শুনার পরে তাকে জিজ্ঞেস করেছি এত জ্ঞানী হয়ে তার অবস্থা এমন কিভাবে হল। বিশাল সে কাহিনী। সংক্ষেপে আমি বলি। কাক-ভূষণ্ডি প্রথমে মানুষ ছিল, এমনিতে ভালই ছিল, ভক্ত ছিল, কিন্তু উলটাপালটা করত। তাই শিবদেবের কাছ থেকে অভিশাপ পেয়েছিল যে সে সর্পযোনী প্রাপ্ত হবে মানে সাপ হবে, অজগর হবে। সেখানে এক সাধু ছিলেন, তিনি শিবকে ‘নমামি শমিশান নির্বাণরূপম’ বলে স্তুতি করলে শিব বলেন যে, কথা বৃথা যাবে না তবে এই অভিশাপ কাকভূষণ্ডির জন্য ‘শাপে বর’ হবে, তাকে এক সহস্র বার জন্ম নিতে হবে। এভাবে অনেক অনেক জন্মের পরে কাকভূষণ্ডি ব্রাহ্মণ হল। সে ঋষি লোমাশার কাছে গিয়েছিল নিগূঢ় দর্শন জানতে। ঋষি তাকে বুঝান, তার মনপূতঃ, সে আবারও বুঝিয়ে দিতে বলে। এভাবে একসময় লোমাশা রেগে যান যে এত করে বুঝিয়ে বলছেন তবুও সে মন দিয়ে শুনছে না। তাদের মাঝে বিতর্ক সৃষ্টি হয়। লোমাশা ঠিকই বলেছিলেন, কিন্তু তা বুঝার মত অবস্থায় ছিল না কাক-ভূষণ্ডি। পরে আর কি হবে, যা হবার তাই হল, আবার অভিশাপ খেলো। কাকের মত ব্যাবহার করেছিল বলে কাক হবার অভিশাপ পেল। পরে আবার লোমাশাই তাকে নির্বানের পথ বলে দিয়েছিলেন। কাক-ভূষণ্ডি সাতাশ জন্ম কাক হয়ে রইল রামকথা গাইতে গাইতে। সরোবরের ধারে ছিল তার নিবাস। সেখানে গরুড়কেও শুনিয়েছিল।



কালীয়ের যখন ফণাগুলো ভেঙেগেছে,দেহ অবসন্ন, নাক থেকে রক্ত ঝরছে তখন নাগ-পত্নীরা চারদিক ছুটে আসছে কৃৃষ্ণের কাছে কালীয়র অপরাধের মুক্তি কামনায়। তারা হাতজোড় করে আশ্রয়দাতা কৃৃষ্ণকে বলতে লাগল-- সাধারনত কেউ যদি কাউকে প্রহার করতে থাকে তখন বন্ধু-বান্ধবরা এসে জিজ্ঞেস ক'রে ওকে কেন মারছেন? কিন্তু নাগ-পত্নীরা তা করল না। তারা এসে বলল --"ন্যায্যো হি দন্ডঃ" ঠিক করেছেন। আপনি যথার্থ দন্ডদাতা। আমাদের স্বামী যে অপরাধ করেছেন তার উপযুক্ত শাস্তিই দিয়েছেন। খল ব্যক্তিকে দন্ড দিতেই আপনার অবতার গ্রহন। আপনি যদি কাউকে আঘাত করেন তবে তার কল্যাণ কামনা ছাড়া আর কোনও অভিপ্রায় থাকে না। আপনি যখন কোন পাপীকে আঘাত করেন তখন আপনার হাতে পাপীর পাপ নাশ হয়। তাই আপনার ক্রোধকে ভক্তরা 'অনুগ্রহ' বলে কীর্ওন করে। আমরা ভাবছি মহা নৃশংস খল কালিয় পূর্বজন্মে এমন কি পূণ্য করেছিল, যার ফলে আপনি শ্রীচরণ দিয়ে আঘাত করে দন্ড দিচ্ছেন! আপনার শ্রীচরণ বহু ভক্তের আরাধ্য ধন। এমন কি স্বয়ং লক্ষীদেবীরও আরাধ্য আপনার শ্রীচরণ। শুনেছি মৃত্যুকালে আপনার শ্রীচরণ স্মরণ করলে জীব মুক্তিলাভ করে। সেই চরণযুগল এখনও এর মাথায় দিয়ে আপনি স্হির হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। লোকের মুখে শুনি গয়াসুরকে আপনি চরণ দিয়ে আঘাত করে শাসন করেছিলেন, সেই চরণ চিহ্ন এখনও তাঁর শিরে বিদ্যমান। তাতে পিন্ড দিয়ে লক্ষ লক্ষ লোক উদ্ধার হচ্ছে। সেই চরণযুগল এর স্পর্শ মহাপাপী কালিয় কি ক'রে লাভ করল আমরা সেটাই বুঝতে পারছিনা। আপনি অন্তর্যামিরূপে সর্ব হৃদয়ে বিরাজমান। আপনার কাছে আমাদের একটাই প্রার্থনা, আমাদের স্বামীকে আপনি বাঁচিয়ে দিন। স্বামীকে আমরা খুব ভালোবাসি। ও মারা গেলে আমরা দুর্দশাগ্রস্ত হব। ও মারা গেলে, আপনি যে তাঁকে চরণযুগল দিয়ে অফুরন্ত কৃপা করছেন তা কেউ জানতেও পারবে না। আপনার কৃপামাহাত্ম অনুভব করতে করতে আপনার করুণাসমুদ্রে ভাসমান হয়ে ও আরও কিছুকাল বেঁচে থাকুক। এইজন্য আমাদের একটি প্রার্থনা -- "পতি প্রাণঃ প্রদীয়তাম্।" প্রভু আমাদের স্বামীর জীবন ভিক্ষা চাওয়ার একটা কারণ আছে। আপনি অন্তর্যামী। সবই জানেন, তবুও বলছি-- আমাদের স্বামী দুর্দান্ত পাতকী ছিলেন। স্বামী পাপী হলে পত্নীদের যে কি দুঃখ তা দীর্ঘকাল বুঝেছি। আপনার চরণস্পর্শে এখন ভক্ত হবেন। তাই বলছি, যদি কৃপা করে ওকে বাঁচিয়ে দেন তবে ভক্ত স্বামীর সংসার করা যে কি সুখ তা অনুভব করতাম।"