Header Ads Widget

নিত্য আনন্দের পথ

সাধুর কথা শুনে সাধুকে চিনতে হয়


নিত্য আনন্দের পথ নির্দেশ, প্রবচন- শ্রীমৎ জয়পতাকা স্বামী মহারাজ
মহাদেব হলেন ভগবানের অংশের অংশ– তিনি একজন অবতার। মহাদেব শিব হচ্ছেন তমোগুণের দেবতা, বৈষ্ণবশ্রেষ্ঠ। তিনি জগতে অবতীর্ণ হন পতিতদের উদ্ধার করার জন্য এবং ভগবানের কাজ সম্পন্ন করার জন্য। ভাগবতের চতুর্থ স্কন্ধের ২য় অধ্যায়ে বর্ণিত কাহিনীতে দক্ষ ছিলেন একজন প্রজাপতি, তাঁর ষোলটি কন্যা ছিল। সব থেকে কনিষ্ঠ ছিল সতী, কিন্তু সতীর কাছে দক্ষ কথা বলতেন না। সতীর সাথে মহাদেবের বিবাহ হয়েছিল। দক্ষ মহাদেবকে হিংসা করতেন, ভাবতেন, এ আমার কি রকম জামাই হল? আমার আর সব জামাইরা খুব ভাল, ভদ্র, সাধু ঋষি; কিন্তু কনিষ্ঠ কন্যা দান করলাম এমন এক জামাইকে যে শ্মশানে থাকে, বিভিন্ন রকম অসভ্য ব্যক্তির সাথে তার মেলামেশা, ভূতেদের সাথে মেশে– কি অবস্তায় না এখন আমার কন্যাকে বাস করতে হচ্ছে!
এইসব চিন্তা করে দক্ষ মহাদেবকে ঘৃণা করতেন। কিন্তু মহাদেব এভাবে ভূত-প্রেত অসুরদের উদ্ধার করছেন, দয়া করছেন অথচ তাদের সঙ্গের প্রভাবে কলুষিত হননি। তাঁর পারমার্থিক প্রভাব এত দৃঢ় যে, অশুচি স্থানে থাকলেও তিনি সব সময়ে পবিত্র হয়ে থাকেন।
সাধুকে বিচার করতে গেলে, দেখে বিচার করতে হয় না, তাঁর কথা শুনে জানতে হয়, অর্থাৎ আসল স্বভাবকে জানতে হয়। বহিরঙ্গা মহাদেবকে দেখে মনে করছে যে, শ্মশান, মৃত্যুর দ্বারা সে অশুচি।
ভাগবতে লেখা আছে– প্রচেতাগণ যখন ধ্যান করছিলেন, তখন মহাদেব তাঁদের কাছে গিয়ে সবাইকে আশীর্বাদ করলেন, শ্রীকৃষ্ণের ভক্ত আমার কাছে সব থেকে প্রিয়। আমার যে পূজা করে, তার থেকে কৃষ্ণভক্তকে আমি বেশি ভালবাসি। তাই আমি তোমাদের একটি মন্ত্র শেখাব, যে-মন্ত্র পাঠ করে তোমরা কৃষ্ণভক্তি লাভ করবে।
মহাদেব শিব হচ্ছেন সবার গুরু। সব থেকে বড় আশীর্বাদ শিবের কাছে পাওয়া যায়– কৃষ্ণভক্তি। সেটা আজকালকার মানুষ চায় না। কেউ চাইছে টাকা, কেউ বাড়ি, চাকুরি, কিন্তু তাঁর কাছে ভগবানের ভক্তি, দিব্য জ্ঞান চাওয়া যায়– এটা সাধারণত কেউ চায় না। জলের মধ্যে একটা মাছ যে দিকে যায়, সব মাছ সেই দিকেই চলে। ওরা চিন্তা করে না, আমি কোথায় আছি। যে মাছ জালে ধরা পড়েছে, সে যদি অন্যদের আসতে বারণ করে, তারা বলে, তুমি গেছ, আমরা যাব না কেন? তুমি নিশ্চয় ভাল আছ, আর আমাদের ভাল চাও না, তাই যেতে নিষেধ করছ যাতে একা একা ভোগ করতে পার, আমরা যাবই।
একে বলে গণগড্ডালিকা। অন্ধ বিশ্বাস করে সবাই যাচ্ছে। এইভাবে যে সাধু হয়েছে, সে সাধু নয়। সে মাছ মাংস বিড়ি খাচ্ছে, বলছে, ভগবানের দরকার নেই, আমি ভগবান। ভগবানের হাতে শঙ্খ চক্র গদা পদ্ম থাকে, কিন্তু বিড়ি হাতে ভগবান কখনও শুনিনি। কিন্তু হাজার হাজার লোক তাই শুনছে। প্রকৃত ভগবান কে, তা জনে না।
শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু বলেছিলেন, সাধু শাস্ত্র গুরুর কাছ থেকে উপদেশ জানতে হয়। শাস্ত্রে কি বলে– ভগবান কি রকম হয়, প্রকৃত গুরুর কি গুণ আছে, প্রকৃত সাধুর কি লক্ষণ– শাস্ত্র থেকে এগুলি জানতে হয়। গীতাতে শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন– বহু রকম বিভূতি ব্যাখ্যা করার কি দরকার, আমার এক অংশ দিয়ে সমস্ত জগৎকে সৃষ্টি করছি এবং স্থায়ী রাখছি। ক্ষুদ্র এক মানুষ মনে করছে, সে ভগবান হয়ে গেল, কিন্তু সে তো জগৎকে স্থায়ী রাখছে না। সে কিছু না কিছু দেখায় বা বলে আর কিছু সময় চলে যায়।
আবার সাধারণ দৃষ্টিতে কেউ বলতে পারে শিব অপবিত্র–শ্মশান, খুলি সাজানো এসব অপবিত্র। মহাদেব শিবকে দক্ষ হিংসা করলেন কিন্তু শিব যে পরম পবিত্র পরম বৈষ্ণব, তিনি ভগবানের অংশপ্রকাশ– এটা তিনি বুঝতে পারেননি।
এই রকম হিংসা করার ফলে দক্ষের সর্বনাশ হল। একজন মহৎ ব্যক্তি, জগৎগুরু, তাঁকে হিংসা করা মহাপাপ, মহা-অপরাধ। দক্ষ একজন নির্গুণ দমন বিশারদ ছিলেন কিন্তু যেহেতু উনি বৈষ্ণব ঠিকমতো নন, তাই উনি উপযুক্ত গুরু নন। কিন্তু যে বৈষ্ণব ভগবানকে ভক্তি করে থাকে, সাধারণ পরিবারে জন্ম হলেও তিনি গুরু হতে পারেন।
ভগবান খুশি হন ভক্তির দ্বারা, ভক্তি দ্বারা তাঁকে জয় করা যায়। অজেয়কে কেউ জয় করতে পারে না কিন্তু ভক্তবৎসল– ভক্তির দ্বারা তিনি পরাজিত হয়ে যান। ভগবান এত দয়াময় যে, যখন উনি ভক্তি দেখেন, মুগ্ধ হয়ে পড়েন, ভক্তকে কৃপা করেন।
পদ্মপুরানে এক পাহাড়ী ব্যক্তি কাহিণী আছে। সে শুদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিল, কোনও শাস্ত্র পাঠ করেনি, কিন্তু কিভাবে বৈষ্ণবের মুখে ভগবানের গুণগান শুনে নিরন্তর ভগবানের নাম উচ্চারণ করতে থাকত। যখন চাষ করত, গোবিন্দ হরি কেশব মাধব কৃষ্ণ ভগবান কেশীনিসূদন– এইবাবে ভগবানের নাম নিরন্তর পাঠ করত। আর সব সময়ে মনে রাখত ভগবানের সেবা হচ্ছে আমাদের জীবনের সব চেয়ে বড় উদ্দেশ্য। কিন্তু ভগবানের সেবা কিভাবে করতে হয়, তা সে ভালভাবে জানত না।
পাহাড়ের মধ্যে যখন কোনও ফল জোগাড় করত, তখন একটু ভাল ফল ভগবানকে নিবেদন করতে হয় জানল। ফল মিষ্টি, কি তেতো, কি টক জানতে একটু মুখে দিয়ে পরীক্ষা করত। ফল ভাল হলে– ‘ভগবান, তোমার চরণের কাছে অর্পণ করছি’, বলে নিবেদন করত। জানত না যে, না খেয়ে ভগবানের কাছে অর্পণ করতে হয়। কিন্তু না জানলেও খুব ভক্তি ছিল। সব সময়ে ভগবানের নাম নিয়ে গুণমুগ্ধ হয়ে থাকত।
একদিন নতুন এক রকম পাহাড়ী ফল সে দেখতে পেল– ছোট্ট মতো। সে ভাবল, ভগবানকে নিবেদন করব কি না আগে দেখি। তখন একটু মুখে দিতে গিয়ে একেবারে গলার মধ্যে আটকে গেল। তখন চিন্তা করল, আমি কি মহাপাপী, ভগবানকে নিবেদন না করে খেয়ে ফেলছি। এখন তা হলে গলার থেকে বার করতে হবে। সে অনেক রকম চেষ্টা করল বার করতে– ভগবানকে নিবেদন করবে।
কিন্তু কোনও রকমে সে গলা থেকে বার করতে পারল না। ভাবছে, এভাবে নিবেদন না করে খেলে আমি পাপী, নিষ্ঠুর হব। তখন কুড়াল দিয়ে নিজের গলা কেটে ফেলল। রক্তপাত হয়ে ফল বার করে ভগবানকে নিবেদন করে মরে গেল।
ভগবান দেখছেন, অদ্ভুত ব্যাপার, আমাকে সন্তুষ্ট করতে গিয়ে নিজের গলা কেটে ফেলল। বিষ্ণু এসে দেখছেন তার মৃতদেহ রয়েছে– তাকে কি আর্শীবাদ দেব? এ রকম তো ইতিহাতে দেখা যায় না। সে তো জানে না, না খেয়ে আমাকে নিবেদন করতে হয়, কিন্তু সব কিছুতে আমাকে সন্তুষ্ট করার ইচ্ছা আছে। আমি তার কাছে কত ঋণী হয়ে পড়লাম।
তখন বিষ্ণু পুনরায় তার প্রাণ ফিরিয়ে আনেন, আত্মা ফিরে আসে এবং তার দেহকে সুস্থ করে দেন। তখন বিষ্ণু ঐ চপ্রিকা পাহাড়ীকে জিজ্ঞেস করেন, তোমার ভক্তি দেখে আমি সন্তুষ্ট হয়েছি, তোমাকে কি বর দেব বল।
চপ্রিকা ভগবান বিষ্ণুর দর্শন পেয়ে প্রণাম করে বলল, তোমার দর্শন পেলাম আমি আর কি চাইব? আমি পাহাড়ী অশুদ্ধ ব্যক্তি, জানি না কি করে তোমার সেবা করতে হয়। তবু তুমি এমন আশীর্বাদ দিলে যে, তোমার দর্শণ আমি লাভ করছি। এর থেকে বড় আশীর্বাদ আর দরকার হয় না। তবে যদি কোনও আশীর্বাদ চাইতেই হয়, তা হলে কখনও যেন তোমার সেবা থেকে বঞ্চিত না হই– সেই আশীর্বাদ আমাকে কর।
এই প্রার্থনা শুনে ভগবান বিষ্ণু আরও খুশি হলেন, বললেন, ‘তোমার ভক্তি দেখে আরও খুশি হলাম এবং আশীর্বাদ দিলাম তুমি আরও ভক্তির মধ্যে থাকবে, এবং ভবিষ্যতে তুমি আমার কাছে আসবে।’ এই বলে বিষ্ণু অন্তর্ধান করলেন।
তখন চপ্রিকা দ্বারকায় গিয়ে ভগবানের সেবা করে পরে শ্রীকৃষ্ণলোকে অবস্থান করলেন। কিভাবে একজন অনভিজ্ঞ ব্যক্তির শুদ্ধ ভক্তি থাকার ফলে ভগবানের কাছে সে যেতে পেরেছে– এটার প্রমাণ পাওয়া গেল।


আরো জানুন
একাদশী
গুরুত্বপূর্ণ তথ্য